Thursday, June 20, 2013

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পুরোপুরি অসত্য, চরম বিভ্রান্তিক ও জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার জাতীয় সংসদে তার বক্তব্যে শাপলা চত্বরে ৫ মে রাতে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে কোনো গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি, হেফাজতের কর্মীরা গায়ে রঙ মেখে রাস্তায় পড়ে ছিল এবং পুলিশ টান দেয়ার পর লাশ দৌড় মারল ইত্যাদি যেসব মন্তব্য করেছেন তা পুরোপুরি অসত্য, চরম বিভ্রান্তিকর এবং জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এমন চরম দায়িত্বহীন মন্তব্যে আমি বিস্মিত, হতবাক। তার মন্তব্যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানানোর ভাষাও আমি হারিয়ে ফেলেছি। কোনো রকমের তদন্ত ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর মতো দায়িত্বপূর্ণ আসনে বসে তিনি কীভাবে এদেশের আলেম-ওলামাদের ওপর ইতিহাসের একটি বর্বরোচিত কলঙ্কজনক ঘটনার ব্যাপারে এভাবে সংসদে দাঁড়িয়ে ডাহা অসত্য কথা বলতে পারলেন! ঘটনার একদিন পরই যেখানে পত্রপত্রিকায় অসংখ্য আহত-নিহত ব্যক্তির ছবি এসেছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে মানুষ মারার ভিডিও চিত্র প্রচারিত হয়েছে এবং অসংখ্য ভিডিও চিত্র এখনও সংরক্ষিত আছে।

প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য শহীদদের লাশ নিয়েও উপহাস করার সামিল, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) হেফাজতের কর্মীরা রঙ মেখে পড়ে ছিল, লাশ পাখির মতো উড়ে গেল ইত্যাদি বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যও করেছেন।
আশপাশের কোনো ভবনে গুলির চিহ্ন নেই দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সেদিন কোনো গোলাগুলির ঘটনাই ঘটেনি। এ ধরনের হালকা কথা দেশের দু-দুবারের একজন প্রধানমন্ত্রীর মুখে মোটেও শোভা পায় না। প্রকারান্তরে তিনি এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ও আলেম-ওলামাদের রক্ত নিয়েই উপহাস করেছেন। ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে কী ঘটনা সরকার ঘটিয়েছে সেটা দেশের মানুষ এবং বিশ্ববাসীর কাছে অনেকটাই পরিষ্কার। সেখানে অবস্থানকারী এবং জীবন নিয়ে ফিরে আসা আলেম ওলামারা ঘটনার সাক্ষী। ঘটনার বিবরণ এসেছে আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। দেশীয় সংবাদমাধ্যমেও কিছুটা এসেছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইন্টারনেট, ব্লগে ঘটনার ধারণ করা ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে পরিষ্কার, সেদিন শাপলা চত্বরে ঘুমন্ত ও জিকিররত আলেম ওলামাদের ওপর হাজার হাজার পুলিশ, র্যাব, বিজিবিকে দিয়ে রাস্তার বাতি নিভিয়ে হামলা করে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে চালানো হামলার সঙ্গে সঙ্গেই আহত নিহতদের ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং রাস্তা পরিষ্কার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে মিডিয়া ছিল বলে যে কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাও অসত্য। মিডিয়াকে অনেক দূরে রাখা হয়েছিল এবং ঘটনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর শেষের দিকে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে দিয়েছিল। তারপরও মিডিয়া ঘটনার অনেক বীভত্স চিত্র ধারণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সরকারের বাধার কারণে মিডিয়া সেগুলো পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারেনি। ওই রাতেই দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাই সেটা প্রমাণ করে।

ঘটনার পরের দিন থেকে হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে হেফাজতকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা শুরু করে সরকার। হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ নেতাদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আল্লামা বাবুনগরীকে মারাত্মকভাবে অসুস্থ করে হাসপাতালে ভর্তি করে সম্প্রতি মুক্তি দেয়া হয়। তিনি এখনও হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর নানা হুমকি-ধমকি, আহত-নিহতদের পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত আছে। অনেক পরিবারকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য চাপ দেয়া হয়। ফলে আহত-নিহতদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এ ধরনের ঘটনায় আহত-নিহতদের সঠিক সংখ্যা কখনও জানা যায় না- এমন কথা দেশীয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরেও বলা হয়েছে।

ঘটনার পর হেফাজতকে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। দফতরবিহীনমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চরম উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন, সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ বলতে বলতে নাকি হেফাজতের কর্মীরা পালিয়ে গেছে। ওইদিন হেফাজতে ইসলাম তাণ্ডব চালিয়েছে বলে সরকারি তরফে বিভিন্নভাবে প্রচার করা হচ্ছে। হেফাজতের বিরুদ্ধে কোরআন পোড়ানোর অভিযোগ করা হচ্ছে। সর্বশেষ প্রধামন্ত্রী বললেন রঙ মেখে লাশের ভান করে হেফাজতকর্মীরা রাস্তায় পড়ে থেকে নাটক করেছে। সরকারের এ ধরনের আচরণ থেকেই অনুমান করা যায়, আসলে সেদিন কী ঘটেছিল।
ঘটনায় নিহত হওয়ার সংখ্যা যাই হোক, ঘটনাটি গণহত্যা এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকারি বাহিনী কর্তৃক তার নাগরিকদের ওপর এমন হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনা এরআগে আর ঘটেনি। এই ঘটনাকে ’৭১ এ পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করা যায়।

হেফাজতে ইসলাম শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা, ব্যাপক রক্তপাত ও হতাহতের ঘটনায় দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ চিন্তা করে ঘটনার পর অত্যন্ত দায়িত্বশীল আচরণ করে। হরতাল আহ্বান করেও তা প্রত্যাহার করে নেয়। এখনও আমরা বড় কোনো আন্দোলন কর্মসূচি দিইনি। ধর্মপ্রাণ মানুষ ধৈর্য ধারণ করছে। আমরা আল্লাহর দরবারে দোয়া মোনাজাতের মধ্যেই আমাদের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রেখেছি। আল্লাহতায়ালার কাছে বিচারের ভার অর্পণ করি। যে ইসলামকে বুকে ধারণ করে, কোরআন ও রাসুলের ইজ্জতকে রক্ষার জন্য আমরা ১৩ দফা আন্দোলনে নামি, সেই ঈমানি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কোরআন পোড়ানোর মতো অপবাদ দিতেও এই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা একটুও দ্বিধা করেনি। যারা কোরআনের সম্মান রক্ষায় জীবন দিতে পারে, তারা কোরআন পোড়াবে—এমন কথা এদেশের ঈমানদার একটি মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে না।

ঘটনার পর আমরা বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার ঘটনার দেড় মাস পরও কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। ঘটনার প্রকৃত তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন থেকে বিরত রয়েছে বলে আমরা মনে করি। এতদিন চুপ করে থাকার পর হঠাত্ করে প্রধানমন্ত্রী কেন ৫ মে ঘটনার ব্যাপারে এভাবে অসত্য তথ্য দিলেন, ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করলেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ করলেন, তা সবাই বুঝতে পারছে। আমরা আগেই সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম, প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে, ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে, ঘটনার জন্য দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করে এবং হেফাজতের ১৩ দফা দাবি মেনে নেয়ার জন্য। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে হেফাজতকে দমিয়ে রাখা এবং প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার পথ বেছে নিয়েছে। এটা যে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর হবে, তা আমরা হুশিয়ার করেছি। শাপলা চত্বরের ঘটনা দেশের আগামী দিনের প্রতিটি ঘটনার ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে বলেও হেফাজতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। সেটার প্রতিফলন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে দেশের মানুষ সরকারের কথায় বিশ্বাস করতে পারে না; সেটা সবার বোঝা উচিত।

আমি শাহ আহমদ শফী, ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার ব্যাপারে সংসদে প্রদত্ত বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, ৫ মে ঘটনার ব্যাপারে প্রশাসন আপনার আশপাশের লোকরা হয়তো আপনাকে বিভ্রান্ত করেছে। আপনাকে সঠিক তথ্য দেয়নি। আপনি প্রকৃত ঘটনা না জেনেই হয়তো এমন মন্তব্য করেছেন। আপনি দেশের একটি ঐহিত্যবাহী রাজনৈতিক দলের প্রধান। দেশের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী। আপনি কোনো কথা বলার আগে ভালোভাবে জেনে বুঝে বলবেন- এমনটিই কাম্য। আপনার কথাকে কেউ মিথ্যা আখ্যায়িত করাটা আপনার অবস্থান ও পদ পদবীর সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

দেরিতে হলেও একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে পুরো ঘটনাটি তদন্ত করে ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য আবারও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাই। একই সঙ্গে সংবিধানে আল্লাহ ও আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের নীতি পুনঃস্থাপন, মহানবীর অবমানাকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে আইন পাস, নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবি মেনে নিয়ে ঈমানদার ধর্মপ্রাণ মানুষের ক্ষোভ কমানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।

আল্লামা শাহ আহমেদ শাফী
আমির
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ

No comments:

Post a Comment

ঘোষনাঃ ৫ই মে' এর যে কোন দৃশ্য আপনার মোবাইল ফোন বা ক্যামেরায় ধারন করা কোন ছবি বা ভিডিও যদি থাকে তা নিজ দ্বায়িত্বে অনলাইন এ্যাক্টিভিটিস নেটওয়ার্কের কাছে প্রেরন করুন অথবা আমাদের ইমেইল করুন-
hifazatheislam@gmail.com
আপনার পাঠানো যে কোন তথ্য করতে পারে সত্যকে প্রস্ফুটিত।


 
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা আন্দোলন নিয়ে সরকার জনগণের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। ধোকা দেয়ার চেষ্টা করছে। সরকারের মনে রাখা উচিত, ধোকাবাজি করে পার পাওয়া যাবে না
---
মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক
বাংলাদেশের নাস্তিকরা ফেরাউন নমরুদের চেয়েও জঘন্য
---
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, মুফাসসীরে কোরআন মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী