আজ সকাল সাড়ে ১১টায় রাজধানীর লালবাগ মাদ্রাসায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আল্লামা শফী ‘ঢাকা অবরোধ’ ও ১৩ দফা দাবির ব্যাপারে একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা আপনাদের সুবিদার্থে পুর্ন বক্তব্য তুলে ধরলাম-
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ আয়োজিত আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে হাজির হওয়ার জন্য আপনাদেরকে জানাচ্ছি আন্তরিক অভিন্দন ও মোবারকবাদ।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
বিগত ৬ এপ্রিল লংমার্চ পরবর্তী মতিঝিল শাপলা চত্বরে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ মহসমাবেশ থেকে ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামীকাল ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ! ইতিমধ্যেই এই কর্মসূচী সফলের সর্বাত্মক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজারো নবীপ্রেমিক জনতা ঢাকা এসে পৌঁছে গেছেন। আরো লাখ লাখ তাওহীদি জনতা ঢাকা অভিমুখে আজই যাত্রা শুরু করেছেন বলে আমাদের কাছে সংবাদ রয়েছে। সরকার ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের হাজারো বাধা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে যে ঈমানদীপ্ত কাফেলা ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছেন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তাদেরকে আর কেউ রুখে রাখতে পারবে না।
শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি আমাদের আন্দোলন অহিংস, অসহিংস। আমরা শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। জ্বালাও পোড়াও, হিংসা¬ হানাহানিতে আমরা বিশ্বাসী নই। বিগত সময়ের সব কয়টি কর্মসূচী বিশেষত ৬ এপ্রিল লংমার্চ পরবর্তী মহাসমাবেশে আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে দেখিয়েছি। কিন্তু বর্তমান সরকার আমাদের কর্মসূচীগুলো বাধাগ্রস্ত ও বানচাল করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে হরতাল, অবরোধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করার অপচেষ্টা করেও তা সফলে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
আমরা সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই ১৩ দফা মেনে নিন। ভয়ভীতির মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূল প্রেমিকদের দমানো যাবে না। যে কোন মূল্যের বিনিময়ে আগামীকাল ৫মের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী সফল করা হবেই ইনশাআল্লাহ। আমরা সারাদেশ থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হাতে তাসবীহ, জায়নামায, মিসওয়াক ও শুকনো খাবার নিয়ে আগামীকাল ফজরের সময় ঢাকার সব কয়টি প্রবেশপথে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবরোধ কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য ময়দানে নেমে আসার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
মনে রাখতে হবে, আমাদের ১৩ দফার এই আন্দোলন নিরেট একটি ঈমানী আন্দোলন। কাউকে ক্ষমতা থেকে হটানো বা কাউকে ক্ষমতায় বসানো আমাদের আন্দোলনের লক্ষ্য নয়। ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোন রাজনৈতিক অভিলাষ আমাদের নেই। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা দেশে বা দেশের বাইরে কোন মহলকে শত্রু কিংবা মিত্র হিসেবে সাব্যস্ত করতে চাই না। দেশের নিয়মতান্ত্রিক ধারা অক্ষুন্ন রাখা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের উদ্বেগ ও প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দেয়ার মধ্য দিয়ে আমরা কেবলই আমাদের ঈমান ও ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্নে অটল ও অবিচল থাকতে চাই। তাই আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক কোটি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের ময়দানে অবস্থান করছি।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে দেয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য কোনো মত ও দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। বরং বিভিন্ন বিষয়ে তার বক্তব্যে স্ব-বিরোধী ভুল ব্যাখা ও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাই ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। সে কারণেই আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপর ভরসা রেখে হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ৫মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী যথারীতি বহাল রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করছি। আমরা ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক মানুষকে কোনো রকম বিভ্রান্তির শিকার না হয়ে পূর্ণ উদ্যম ও প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার আহবান জানাচ্ছি। আমরা সাভারের মর্মান্তিক ঘটনায় উদ্ধার কাজ, রক্তদান কর্মসুচী, নগদ অর্থ প্রদান ও অসহায়দের পাশে দাড়ানোর ব্যাপারে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করেছি। মানবিক বিবেচনায় আমাদের এই তৎপরতা সবসময় অব্যাহত আছে এবং থাকবে। সুতরাং সাভার ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত লাশবাহী গাড়ি, এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত সর্বপ্রকার যানবাহন, দেশী বিদেশী পরিদর্শকদের গাড়িসহ এ জাতীয় সবরকম যানবাহন অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে। আমাদের সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের কাছে এই নির্দেশ পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে। মানবিক এসব দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে তাদের যানবাহনে স্টীকার ব্যবহারের অনুরোধ করছি।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করার আহবান জানিয়েছেন। তিনি সাভার ট্রাজেডি সংশ্লিষ্ট মানবিক বিবেচনাসহ হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ১৩ দফার বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য পরিস্কার। তার বক্তব্যে ১৩ দফা মেনে নেয়ার কোনো রকম সিদ্ধান্ত ও নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। বরং এ সব দাবির বিষয়ে কিছু বিভ্রান্তিকর কথা ও হেফাজতের ইসলামকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যই উঠে এসেছে। এতে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি স্থগিতের মতো কোনো রকম উপাদান নেই বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্ব-বিরোধিতার বহু নজির ফুটে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার হেফাজতের ১৩ দফা ‘সংবিধানবিরোধী’ ও ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বলার পরও তিনি বিভিন্ন দফার পয়েন্ট উল্লেখ করে সেসব দফার পক্ষে প্রচলিত আইনে কী কী ধারা-উপধারা রয়েছে তাও উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে ভুল ও অসত্য ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে দফাগুলোর অযৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
নিম্নে আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কতিপয় দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুণঃস্থাপনের বিষয়টি পাশ কাটিয়ে ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ উল্লেখ থাকার কথা বললেও ঐ মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি পুণঃস্থাপন নিয়ে কোন প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেননি। বরং ঐ ঈমানী বাক্যটি পুণঃস্থাপনের বিষয়ে তার অনীহা ও অনিচ্ছার কথাই তুলে ধরেছেন। মনে রাখা দরকার যে, ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ও ‘বিসমিল্লাহর’ সম্পর্ক আমলের সাথে। আর ‘আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’-এর সম্পর্ক বিশ্বাস ও আক্বীদার সাথে। এই বিশ্বাস ও আস্থা বাদ দিলে মুমিনের কোন আমলেরই কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। অতএব, হাজার হাজার শব্দমালার সংবিধানে ঈমানী এই ক’টি শব্দ পুন:স্থাপনে প্রতিবন্ধকতা কোথায় সেটিই আমাদের বোধগম্য নয়। ইসলাম অবমাননা ও কটুক্তি বিষয়ে প্রচলিত ‘ধর্ম অবমাননা আইন’ ‘স্পেশাল পাওয়ার এক্ট’ এবং ‘তথ্য প্রযুক্তি আইনের’ ধারায় বর্ণিত শাস্তির কথা তুলে ধরলেও সর্বোচ্চ শাস্তির আইন প্রণয়ন বিষয়ে কোন কথা তিনি বলেননি।
এ ধরনের অপরাধের শাস্তি হিসাবে প্রচলিত আইনকে যথার্থ মনে করার কোন সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী যে সমস্ত আইনের কথা তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, এগুলো বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও দেশে ধর্ম অবমাননার মাত্রা ও প্রবণতা, আগের যে কোন সময়ের তুলনায় ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সরকারের অনুগত একটি শ্রেণির মাধ্যমে ৮৪ জন ইসলাম অবমাননাকারী নাস্তিক ব্লগারের যে তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তাদের মধ্যেও ৪ জনকে মাত্র ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এ জন্য তথ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে কমিটি করার আশ্বাসবাণী শোনালেও সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বক্তব্যে ‘৪২ বছরে ইসলাম অবমাননার কোন ঘটনাই ঘটেনি’ এ জাতীয় বক্তব্য বারবার গণমাধ্যমে আসছে।
এ জাতীয় উদ্যোগের বাস্তবতা নিয়ে কোনভাবেই সন্দেহমুক্ত থাকা যায় না। একই সঙ্গে এরই মধ্যে গ্রেফতারকৃত ৪জন ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগারের বিরুদ্ধেও বিদ্যমান আইনে কঠোর কোন ধারায় মামলা করা হয়নি এবং তাদের দৃষ্টিকটু আদর আপ্যায়নে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আলেম উলামা, ইমাম, খতীব ও মাদরাসার ছাত্রদের হয়রানি, হুমকির বিষয়টির সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করা হলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আন্দোলনরত দশ জন আলেমকে হত্যা করা হয়েছে। বহু আলেম খতীবকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে, বেশকিছু মাদরাসা বাধ্যতামুলক সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাকাসহ দেশজুড়ে আলেম ও আন্দোলনরত ধর্মপ্রাণ মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে এবং এখনও করা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়েরের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও সত্য এটাই যে, এসবের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি সরকার দলীয় এমপি, নেতা ও সংগঠনভুক্ত কর্মীরাই ঘটনাগুলো ঘটিয়ে চলেছে। তিনি ভাস্কর্য ও মূর্তির মাঝে ব্যবধান তৈরী করে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা ইসলামের মৌলিক নীতি এবং বিধানের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি ভাস্কর্যকে স্মৃতি রক্ষার মাধ্যম হিসেবে বৈধতা দিতে চাইলেও ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি পূজার প্রচলন হয়েছে স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে মূর্তি বানিয়ে রেখে দেয়ার সূত্র ধরেই। তাই এটি একটি বিভ্রান্তকর বক্তব্য। তিনি কোন কোন আরবদেশের উদাহরণ টেনে বলেছেন, ইসলাম ভাস্কর্যকে উৎকর্ষ দান করেছে। এটাও ইসলামের মৌলিক নীতির সম্পর্কে একটি ভুল ব্যাখ্যা।
তিনি নারীনীতি, নারী-অধিকার, অশ্লীলতা, ব্যভিচার ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামী অনুশাসনের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। আবার নারীনীতির ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারার বিষয়ে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে গেছেন। ব্যভিচারের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করলেও ব্যাভিচারের দিকে ধাবিত করে- এমন অশ্লীল নৃত্য ও অবাধ মেলামেশার প্রকাশ্য অনুসঙ্গকে শাহবাগসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহিত করা হয়েছে। তাছাড়া ১৩ দফার এই ধারাটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দল ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা বারবার আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে এসেছেন এবং বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনকে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়ার অপচেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে তিনি ইতিবাচক সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য দেননি। একইভাবে শিক্ষানীতিসহ আরো বেশ কয়েকটি বিষয়ে ইতিবাচক কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য ছাড়াই ধোঁয়াশাপূর্ণ অস্পষ্ট বক্তব্য তিনি প্রদান করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মসজিদের খতীবদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে ‘গীবত’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার কিংবা সরকারের মদদপুষ্ট কোন মহলের ইসলামবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো ও মুসল্লিদের সতর্ক করা একজন খতীবের পবিত্র দায়িত্ব। এটা গীবত নয়; বরং সর্বোত্তম জেহাদ। খতীবদের সেই পবিত্র দায়িত্বকেই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ‘গীবত’ হিসাবে আখ্যা দেয়ার দ্বারাই সারাদেশের মসজিদের ইমাম ও খতীবদের প্রতি সরকার ও সরকারী দলের বিরূপ মনোভাবের প্রকৃত চেহারা ফুটে ওঠেছে। দেশের লাখ লাখ ইমাম খতীবদের প্রতি কোন সরকারের শীর্ষ মহলের এ ধরনের মনোভাব কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মোমবাতি প্রজ্বলনের বিষয়ে হেফাজতের দাবি নিয়ে তিনি তার বক্তব্যে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যে কোন মানবিক ও বাস্তব প্রয়োজনে যে কোন প্রকার আগুন ও জ্বালানির ব্যবহার ইসলামী শরীয়তে অনুমোদিত। এটা অতীতেও ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু বাস্তব প্রয়োজন ছাড়াই সংস্কৃতির অংশ হিসাবে কিংবা প্রতিকী কোন তাৎপর্য বহন করে মোমবাতি বা মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে কোন অনুষ্ঠান, কোন আয়োজন সম্পন্ন করা ইসলামী শরীয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি স্পষ্টই অগ্নিপূজারী ও শিরকী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে ভিন্ন ধর্মীয় এই সংস্কৃতির সঙ্গে বাস্তব প্রয়োজনে ব্যবহৃত অগ্নি প্রজ্বলনের বিষয়টিকে হতাশাজনকভাবে গুলিয়ে ফেলেছেন। একটি আচরণের বাস্তব দিক ও সাংস্কৃতিক দিকের পার্থক্যকে এভাবে একাকার করে ফেলা তার অবস্থানের সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার বেশ কয়েকটি দফার অনুকুলে বিভিন্ন আইনের ধারা-উপধারা উল্লেখ করে এমন দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের নামে কোন বাড়াবাড়ি সহ্য করা হবে না বলে তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এতে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি এবং চলমান অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে তার সরকারের কোন কোন কট্টর বামপন্থী মন্ত্রীর মিথ্যাচারপূর্ণ ও উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রতিধ্বনি ফুটে ওঠেছে। প্রশাসনের নির্বিচার নির্যাতন ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের প্রকাশ্যে রামদা, চাপাতি, লাঠি ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ার পরও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলামের প্রতি জঙ্গিবাদের অভিযোগের আঙ্গুল তাক করা বড়ই বেদনাদায়ক। তার এই বক্তব্যে প্রকৃতপক্ষে সরকার ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আড়াল করার অপচেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
নাটক সিনেমায় ইসলামের নির্দশন দাড়ি টুপি ইত্যাদি সম্মানিত নিদর্শনাবলীকে খল চরিত্র দ্বারা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন আমরা তার এই ইতিবাচক বোধকে স্বাগত জানাই। তবে এ জাতীয় নিন্দনীয় প্রবণতা বন্ধের ক্ষেত্রে তার বক্তব্যে কোন দিক-নির্দেশনা নেই। আমরা মনে করি ১৩ দফার অন্য দফা গুলো নিয়েও আন্তরিক বোধ ও উপলব্ধির সঙ্গে চিন্তা ভাবনা করলে তার একই ধরনের বোধ জাগ্রত হতে পারত। আমরা আশাবাদী তিনি ও তার সরকার আন্তরিক বোধ ও উপলব্ধি নিয়ে আমাদের ১৩ দফার প্রতিটি দফা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের ঈমানী দাবি ও ধর্মীয় অধিকারের বিষয়ে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই অন্তসারশূন্য বক্তব্যের মাধ্যমে এটিই প্রতীয়মান হয় তিনি তার এসব বক্তব্যে মোটেও আন্তরিক নন। তাই আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হল-
ক. ধোঁকা, অস্পষ্টতা, বিভ্রান্তি ও ধুম্রজালের আশ্রয় না নিয়ে অবিলম্বে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি মেনে নিন।
খ. এই আন্দোলনে এ যাবৎ যারা শহীদ হয়েছেন সেইসব শহীদ পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা, গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে মুক্তি এবং মিথ্যা হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক সব মামলা প্রত্যাহার করে নিন।
গ. ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের মুখোশ উন্মোচনকারী, সত্যবাদী ও সাহসী সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি ও আমার দেশ ছাপাখানা খুলে দিয়ে পত্রিকাটির প্রকাশনার ব্যবস্থা করুন।
ঘ. আগামীকালের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীসহ হেফাজতে ইসলামের চলমান সব আন্দোলন ও কর্মসূচীকে সফল করার জন্য সরকার ও প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতা নিশ্চিত করুন।
এছাড়া বিকল্প পথে এগুতে চাইলে সরকারকে এর জন্য চরম খেসারত দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তাওফীক দান করুন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
আমাদের সংবাদ সম্মেলনে হাজির হওয়ার জন্য আবারো আপনাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
- আল্লামা শাহ আহমদ শফী
আমীর, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ আয়োজিত আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে হাজির হওয়ার জন্য আপনাদেরকে জানাচ্ছি আন্তরিক অভিন্দন ও মোবারকবাদ।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
বিগত ৬ এপ্রিল লংমার্চ পরবর্তী মতিঝিল শাপলা চত্বরে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ মহসমাবেশ থেকে ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামীকাল ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ! ইতিমধ্যেই এই কর্মসূচী সফলের সর্বাত্মক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজারো নবীপ্রেমিক জনতা ঢাকা এসে পৌঁছে গেছেন। আরো লাখ লাখ তাওহীদি জনতা ঢাকা অভিমুখে আজই যাত্রা শুরু করেছেন বলে আমাদের কাছে সংবাদ রয়েছে। সরকার ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের হাজারো বাধা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে যে ঈমানদীপ্ত কাফেলা ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছেন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তাদেরকে আর কেউ রুখে রাখতে পারবে না।
শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি আমাদের আন্দোলন অহিংস, অসহিংস। আমরা শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। জ্বালাও পোড়াও, হিংসা¬ হানাহানিতে আমরা বিশ্বাসী নই। বিগত সময়ের সব কয়টি কর্মসূচী বিশেষত ৬ এপ্রিল লংমার্চ পরবর্তী মহাসমাবেশে আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে দেখিয়েছি। কিন্তু বর্তমান সরকার আমাদের কর্মসূচীগুলো বাধাগ্রস্ত ও বানচাল করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে হরতাল, অবরোধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করার অপচেষ্টা করেও তা সফলে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
আমরা সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই ১৩ দফা মেনে নিন। ভয়ভীতির মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূল প্রেমিকদের দমানো যাবে না। যে কোন মূল্যের বিনিময়ে আগামীকাল ৫মের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী সফল করা হবেই ইনশাআল্লাহ। আমরা সারাদেশ থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হাতে তাসবীহ, জায়নামায, মিসওয়াক ও শুকনো খাবার নিয়ে আগামীকাল ফজরের সময় ঢাকার সব কয়টি প্রবেশপথে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবরোধ কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য ময়দানে নেমে আসার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
মনে রাখতে হবে, আমাদের ১৩ দফার এই আন্দোলন নিরেট একটি ঈমানী আন্দোলন। কাউকে ক্ষমতা থেকে হটানো বা কাউকে ক্ষমতায় বসানো আমাদের আন্দোলনের লক্ষ্য নয়। ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোন রাজনৈতিক অভিলাষ আমাদের নেই। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা দেশে বা দেশের বাইরে কোন মহলকে শত্রু কিংবা মিত্র হিসেবে সাব্যস্ত করতে চাই না। দেশের নিয়মতান্ত্রিক ধারা অক্ষুন্ন রাখা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের উদ্বেগ ও প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দেয়ার মধ্য দিয়ে আমরা কেবলই আমাদের ঈমান ও ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্নে অটল ও অবিচল থাকতে চাই। তাই আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক কোটি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের ময়দানে অবস্থান করছি।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে দেয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য কোনো মত ও দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। বরং বিভিন্ন বিষয়ে তার বক্তব্যে স্ব-বিরোধী ভুল ব্যাখা ও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাই ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। সে কারণেই আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপর ভরসা রেখে হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ৫মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী যথারীতি বহাল রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করছি। আমরা ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক মানুষকে কোনো রকম বিভ্রান্তির শিকার না হয়ে পূর্ণ উদ্যম ও প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার আহবান জানাচ্ছি। আমরা সাভারের মর্মান্তিক ঘটনায় উদ্ধার কাজ, রক্তদান কর্মসুচী, নগদ অর্থ প্রদান ও অসহায়দের পাশে দাড়ানোর ব্যাপারে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করেছি। মানবিক বিবেচনায় আমাদের এই তৎপরতা সবসময় অব্যাহত আছে এবং থাকবে। সুতরাং সাভার ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত লাশবাহী গাড়ি, এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত সর্বপ্রকার যানবাহন, দেশী বিদেশী পরিদর্শকদের গাড়িসহ এ জাতীয় সবরকম যানবাহন অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে। আমাদের সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের কাছে এই নির্দেশ পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে। মানবিক এসব দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে তাদের যানবাহনে স্টীকার ব্যবহারের অনুরোধ করছি।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করার আহবান জানিয়েছেন। তিনি সাভার ট্রাজেডি সংশ্লিষ্ট মানবিক বিবেচনাসহ হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ১৩ দফার বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য পরিস্কার। তার বক্তব্যে ১৩ দফা মেনে নেয়ার কোনো রকম সিদ্ধান্ত ও নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। বরং এ সব দাবির বিষয়ে কিছু বিভ্রান্তিকর কথা ও হেফাজতের ইসলামকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যই উঠে এসেছে। এতে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি স্থগিতের মতো কোনো রকম উপাদান নেই বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্ব-বিরোধিতার বহু নজির ফুটে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার হেফাজতের ১৩ দফা ‘সংবিধানবিরোধী’ ও ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বলার পরও তিনি বিভিন্ন দফার পয়েন্ট উল্লেখ করে সেসব দফার পক্ষে প্রচলিত আইনে কী কী ধারা-উপধারা রয়েছে তাও উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে ভুল ও অসত্য ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে দফাগুলোর অযৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
নিম্নে আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কতিপয় দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুণঃস্থাপনের বিষয়টি পাশ কাটিয়ে ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ উল্লেখ থাকার কথা বললেও ঐ মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি পুণঃস্থাপন নিয়ে কোন প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেননি। বরং ঐ ঈমানী বাক্যটি পুণঃস্থাপনের বিষয়ে তার অনীহা ও অনিচ্ছার কথাই তুলে ধরেছেন। মনে রাখা দরকার যে, ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ও ‘বিসমিল্লাহর’ সম্পর্ক আমলের সাথে। আর ‘আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’-এর সম্পর্ক বিশ্বাস ও আক্বীদার সাথে। এই বিশ্বাস ও আস্থা বাদ দিলে মুমিনের কোন আমলেরই কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। অতএব, হাজার হাজার শব্দমালার সংবিধানে ঈমানী এই ক’টি শব্দ পুন:স্থাপনে প্রতিবন্ধকতা কোথায় সেটিই আমাদের বোধগম্য নয়। ইসলাম অবমাননা ও কটুক্তি বিষয়ে প্রচলিত ‘ধর্ম অবমাননা আইন’ ‘স্পেশাল পাওয়ার এক্ট’ এবং ‘তথ্য প্রযুক্তি আইনের’ ধারায় বর্ণিত শাস্তির কথা তুলে ধরলেও সর্বোচ্চ শাস্তির আইন প্রণয়ন বিষয়ে কোন কথা তিনি বলেননি।
এ ধরনের অপরাধের শাস্তি হিসাবে প্রচলিত আইনকে যথার্থ মনে করার কোন সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী যে সমস্ত আইনের কথা তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, এগুলো বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও দেশে ধর্ম অবমাননার মাত্রা ও প্রবণতা, আগের যে কোন সময়ের তুলনায় ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সরকারের অনুগত একটি শ্রেণির মাধ্যমে ৮৪ জন ইসলাম অবমাননাকারী নাস্তিক ব্লগারের যে তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তাদের মধ্যেও ৪ জনকে মাত্র ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এ জন্য তথ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে কমিটি করার আশ্বাসবাণী শোনালেও সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বক্তব্যে ‘৪২ বছরে ইসলাম অবমাননার কোন ঘটনাই ঘটেনি’ এ জাতীয় বক্তব্য বারবার গণমাধ্যমে আসছে।
এ জাতীয় উদ্যোগের বাস্তবতা নিয়ে কোনভাবেই সন্দেহমুক্ত থাকা যায় না। একই সঙ্গে এরই মধ্যে গ্রেফতারকৃত ৪জন ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগারের বিরুদ্ধেও বিদ্যমান আইনে কঠোর কোন ধারায় মামলা করা হয়নি এবং তাদের দৃষ্টিকটু আদর আপ্যায়নে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আলেম উলামা, ইমাম, খতীব ও মাদরাসার ছাত্রদের হয়রানি, হুমকির বিষয়টির সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করা হলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আন্দোলনরত দশ জন আলেমকে হত্যা করা হয়েছে। বহু আলেম খতীবকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে, বেশকিছু মাদরাসা বাধ্যতামুলক সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাকাসহ দেশজুড়ে আলেম ও আন্দোলনরত ধর্মপ্রাণ মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে এবং এখনও করা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়েরের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও সত্য এটাই যে, এসবের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি সরকার দলীয় এমপি, নেতা ও সংগঠনভুক্ত কর্মীরাই ঘটনাগুলো ঘটিয়ে চলেছে। তিনি ভাস্কর্য ও মূর্তির মাঝে ব্যবধান তৈরী করে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা ইসলামের মৌলিক নীতি এবং বিধানের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি ভাস্কর্যকে স্মৃতি রক্ষার মাধ্যম হিসেবে বৈধতা দিতে চাইলেও ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি পূজার প্রচলন হয়েছে স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে মূর্তি বানিয়ে রেখে দেয়ার সূত্র ধরেই। তাই এটি একটি বিভ্রান্তকর বক্তব্য। তিনি কোন কোন আরবদেশের উদাহরণ টেনে বলেছেন, ইসলাম ভাস্কর্যকে উৎকর্ষ দান করেছে। এটাও ইসলামের মৌলিক নীতির সম্পর্কে একটি ভুল ব্যাখ্যা।
তিনি নারীনীতি, নারী-অধিকার, অশ্লীলতা, ব্যভিচার ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামী অনুশাসনের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। আবার নারীনীতির ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারার বিষয়ে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে গেছেন। ব্যভিচারের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করলেও ব্যাভিচারের দিকে ধাবিত করে- এমন অশ্লীল নৃত্য ও অবাধ মেলামেশার প্রকাশ্য অনুসঙ্গকে শাহবাগসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহিত করা হয়েছে। তাছাড়া ১৩ দফার এই ধারাটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দল ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা বারবার আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে এসেছেন এবং বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনকে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়ার অপচেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে তিনি ইতিবাচক সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য দেননি। একইভাবে শিক্ষানীতিসহ আরো বেশ কয়েকটি বিষয়ে ইতিবাচক কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য ছাড়াই ধোঁয়াশাপূর্ণ অস্পষ্ট বক্তব্য তিনি প্রদান করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মসজিদের খতীবদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে ‘গীবত’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার কিংবা সরকারের মদদপুষ্ট কোন মহলের ইসলামবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো ও মুসল্লিদের সতর্ক করা একজন খতীবের পবিত্র দায়িত্ব। এটা গীবত নয়; বরং সর্বোত্তম জেহাদ। খতীবদের সেই পবিত্র দায়িত্বকেই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ‘গীবত’ হিসাবে আখ্যা দেয়ার দ্বারাই সারাদেশের মসজিদের ইমাম ও খতীবদের প্রতি সরকার ও সরকারী দলের বিরূপ মনোভাবের প্রকৃত চেহারা ফুটে ওঠেছে। দেশের লাখ লাখ ইমাম খতীবদের প্রতি কোন সরকারের শীর্ষ মহলের এ ধরনের মনোভাব কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মোমবাতি প্রজ্বলনের বিষয়ে হেফাজতের দাবি নিয়ে তিনি তার বক্তব্যে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যে কোন মানবিক ও বাস্তব প্রয়োজনে যে কোন প্রকার আগুন ও জ্বালানির ব্যবহার ইসলামী শরীয়তে অনুমোদিত। এটা অতীতেও ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু বাস্তব প্রয়োজন ছাড়াই সংস্কৃতির অংশ হিসাবে কিংবা প্রতিকী কোন তাৎপর্য বহন করে মোমবাতি বা মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে কোন অনুষ্ঠান, কোন আয়োজন সম্পন্ন করা ইসলামী শরীয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি স্পষ্টই অগ্নিপূজারী ও শিরকী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে ভিন্ন ধর্মীয় এই সংস্কৃতির সঙ্গে বাস্তব প্রয়োজনে ব্যবহৃত অগ্নি প্রজ্বলনের বিষয়টিকে হতাশাজনকভাবে গুলিয়ে ফেলেছেন। একটি আচরণের বাস্তব দিক ও সাংস্কৃতিক দিকের পার্থক্যকে এভাবে একাকার করে ফেলা তার অবস্থানের সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার বেশ কয়েকটি দফার অনুকুলে বিভিন্ন আইনের ধারা-উপধারা উল্লেখ করে এমন দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের নামে কোন বাড়াবাড়ি সহ্য করা হবে না বলে তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এতে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি এবং চলমান অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে তার সরকারের কোন কোন কট্টর বামপন্থী মন্ত্রীর মিথ্যাচারপূর্ণ ও উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রতিধ্বনি ফুটে ওঠেছে। প্রশাসনের নির্বিচার নির্যাতন ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের প্রকাশ্যে রামদা, চাপাতি, লাঠি ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ার পরও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলামের প্রতি জঙ্গিবাদের অভিযোগের আঙ্গুল তাক করা বড়ই বেদনাদায়ক। তার এই বক্তব্যে প্রকৃতপক্ষে সরকার ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আড়াল করার অপচেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
নাটক সিনেমায় ইসলামের নির্দশন দাড়ি টুপি ইত্যাদি সম্মানিত নিদর্শনাবলীকে খল চরিত্র দ্বারা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন আমরা তার এই ইতিবাচক বোধকে স্বাগত জানাই। তবে এ জাতীয় নিন্দনীয় প্রবণতা বন্ধের ক্ষেত্রে তার বক্তব্যে কোন দিক-নির্দেশনা নেই। আমরা মনে করি ১৩ দফার অন্য দফা গুলো নিয়েও আন্তরিক বোধ ও উপলব্ধির সঙ্গে চিন্তা ভাবনা করলে তার একই ধরনের বোধ জাগ্রত হতে পারত। আমরা আশাবাদী তিনি ও তার সরকার আন্তরিক বোধ ও উপলব্ধি নিয়ে আমাদের ১৩ দফার প্রতিটি দফা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের ঈমানী দাবি ও ধর্মীয় অধিকারের বিষয়ে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই অন্তসারশূন্য বক্তব্যের মাধ্যমে এটিই প্রতীয়মান হয় তিনি তার এসব বক্তব্যে মোটেও আন্তরিক নন। তাই আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হল-
ক. ধোঁকা, অস্পষ্টতা, বিভ্রান্তি ও ধুম্রজালের আশ্রয় না নিয়ে অবিলম্বে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি মেনে নিন।
খ. এই আন্দোলনে এ যাবৎ যারা শহীদ হয়েছেন সেইসব শহীদ পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা, গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে মুক্তি এবং মিথ্যা হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক সব মামলা প্রত্যাহার করে নিন।
গ. ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের মুখোশ উন্মোচনকারী, সত্যবাদী ও সাহসী সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি ও আমার দেশ ছাপাখানা খুলে দিয়ে পত্রিকাটির প্রকাশনার ব্যবস্থা করুন।
ঘ. আগামীকালের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীসহ হেফাজতে ইসলামের চলমান সব আন্দোলন ও কর্মসূচীকে সফল করার জন্য সরকার ও প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতা নিশ্চিত করুন।
এছাড়া বিকল্প পথে এগুতে চাইলে সরকারকে এর জন্য চরম খেসারত দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তাওফীক দান করুন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
আমাদের সংবাদ সম্মেলনে হাজির হওয়ার জন্য আবারো আপনাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
- আল্লামা শাহ আহমদ শফী
আমীর, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
No comments:
Post a Comment